চৌমুহনীতে মায়ের কবরে শায়িত হবেন সিরাজুল আলম খাঁ
বিশেষ প্রতিবেদনঃ
নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার আলীপুর গ্রামে মায়ের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হবেন সিরাজুল আলম খান। ছোট ভাই ফখরুল আলম খান বাবুল জানিয়েছেন, শনিবার আছরের নামাজের পর শৈশবের বেগমগঞ্জ পাইলট স্কুল মাঠে তাঁর দ্বিতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর মায়ের কবরের পাশে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হবে। এর আগে সকাল ১০টায় জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণপ্লাজায় প্রথম জানাজা শেষে সড়ক পথে মরদেহ নোয়াখালীতে আনা হয়। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক রাজনীতির ‘রহস্যপুরুষ’ খ্যাত জাতীয় বীর সিরাজুল আলম খানের পারিবারিক সূত্র ও জাসদ নেতারা জানান, মৃত্যুর পর জন্মভূমি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে মায়ের কবরের পাশে যেন দাফন করা হয় এমন ইচ্ছের কথা জানিয়ে গেছেন তিনি। কেন্দ্রীয় জেএসডি’র সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ারুল কবির মানিক বলেন, সিরাজুল আলম খান দাদা ভাই তার শেষ ইচ্ছের কথা সবাইকে আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর কোনো শোকসভা হবে না। শহীদ মিনারে ডিসপ্লে হবে না লাশ। যত দ্রুত সম্ভব নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আমার গ্রামের বাড়িতে পাঠাতে হবে মরদেহ, যা ঢাকা থাকবে একটা কাঠের কফিনে। সিরাজুল আলম খানের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার নিজ গ্রাম নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের চৌমুহনী পৌরসভার আলীপুরের সাহেব বাড়িতে মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হবে।
রাজনীতির রহস্য পুরুষ খ্যাত সিরাজুল আলম খানের পিএস মোশারফ হোসেন মন্টু জানান, নোয়াখালীতে সিরাজুল আলম খানের জানাজা ও দাফনে যোগ দিতে দলের জেএসডি সভাপদি আসম রব, কেন্দ্রীয় বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান আলহাজ মো. শাহাজাহান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সভাপতি আবদুস সালাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পিএস শিমুল বিশ্বাসসহ একটি টিম আসবেন। এছাড়া ঢাকায় জানাজা সহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতায় দলের পক্ষ থেকে যোগ দিতে রওনা হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, সিরাজুল আলম খান ১৯৪১ সালের ৬ই জানুয়ারি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা খোরশেদ আলম ও মা সৈয়দা জাকিয়া খাতুনের পাঁচ পুত্র ও তিন কন্যা সন্তানের মধ্যে সিরাজুল আলম খান ছিলেন দ্বিতীয়। বাবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ায় দেশের বিভিন্ন স্থানে তাঁকে বদলি হতে হয়েছে। সেই সুবাদে সিরাজুল আলম খান দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৬ সালে খুলনা জিলা স্কুল থেকে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে পড়াশোনা করেন। জাসদ কেন্দ্রীয় কার্যকরি কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জিয়াউল হক মুক্তা জানান, ১৯৬২ সালের নভেম্বরে তিনি আব্দুর রাজ্জাক (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতা) ও কাজী আরেফ আহমেদকে (পরবর্তীতে জাসদ নেতা) সাথে নিয়ে পূর্ববাংলার স্বাধীনতার জন্য প্রধানত ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে গঠন করেন গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়া ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ বা ‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস’ বা নিউক্লিয়াস। পরবর্তীতে এই গোপন রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় আরো যোগ দেন আবুল কালাম আযাদ (পরবর্তীকালে প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতা) ও আব্দুল মান্নান (পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা)। দারিদ্র্যের কারণে পরে আবুল কালাম আযাদ শিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত হবার জন্য ও সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় ব্যর্থতার জন্য আব্দুল মান্নানকে এই প্রক্রিয়া থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এঁদের স্থলাভিষিক্ত হন মনিরুল ইসলাম বা মার্শাল মনি (পরবর্তীকালে জাসদ নেতা)। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সালের জন্য ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন শেখ ফজলুল হক মনি। দায়িত্ব গ্রহণের কিছুকালের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনি ব্যক্তিগত কারণে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে চলে গেলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সিরাজুল আলম খান। মূলত এই সময়েই তিনি সারা পূর্ব বাংলায় স্বাধীনতাকামী ছাত্র-তরুণদের বিস্তৃত নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। ১৯৬৩ সালের ৭রা নভেম্বরের সম্মেলনে সিরাজুল আলম খান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালের মার্চের পর তিনি আরো কয়েকজন ছাত্রনেতার সাথে কারান্তরীণ হন। ১৯৬৫ সালের জুলাই/আগস্ট মাসে কারামুক্তির পরে সেপ্টেম্বরের ৫-৬ তারিখে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগ সম্মেলনে তিনি আব্দুর রাজ্জাকের কাছে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। এসময় তিনি আবুল কালাম আযাদকে দায়িত্ব দেন ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় আলোচনার জন্য ‘পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক বৈষম্য’ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র রচনা করতে। আবুল কালাম আযাদ দু’জন স্কুল শিক্ষার্থীর সহায়তা নিয়ে তা রচনা করেন ও ছাত্রলীগের বর্ধিত সভায় পাঠ করেন। বর্ধিত সভার পরে ১৯৬৫ সালের নভেম্বরে ছাত্রলীগের সভাপতি সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী ও আব্দুর রাজ্জাকের ভূমিকাসমেত ছাত্রলীগ ওই গবেষণাপত্রটি জনবোধ্য পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশ করে এবং সারা পূর্ব বাংলায় ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’ নিয়ে ব্যাপক প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করে। ছাত্রলীগ কর্তৃক ‘আঞ্চলিক বৈষম্য’ বিষয়ক প্রচার অভিযানের প্রেক্ষাপটে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষণা করলে ডান-মধ্য-বাম নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক দল এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে। আওয়ামী লীগের সকল সিনিয়র নেতৃত্ব শেখ মুজিব ও ছয় দফার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৬৬ সালেই সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস বিদ্যুৎগতিতে ছয় দফার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে এবং ছয় দফাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধানতম অবলম্বন হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে। সিরাজুল আলম খানের সহযোদ্ধা কাজী আরেফ আহমেদ সর্বপ্রথম ছয় দফা সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করেন। ছয় দফা ঘোষণার অপরাধে পাকিস্তানি শাসকরা শেখ মুজিবকে দ্রুত কারান্তরীণ করলে সিরাজুল আলম খান তাঁর মুক্তির দাবিতে ও ছয় দফার পক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ধর্মঘট সংঘটিত করেন। আওয়ামী লীগের কয়েকজন তরুণ নেতা কর্তৃক এই ধর্মঘট আহুত হলেও সিরাজুল আলম খান ও তাঁর অনুসারীগণ শ্রমিকদের সাথে নিয়ে এই ধর্মঘটকে সাফল্যমণ্ডিত করেন। ছয় দফা আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ দিতে সিরাজুল আলম খান শ্রমিক আন্দোলনের ট্রেড ইউনিয়নবাদি ধারা থেকে বের করে এনে রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে ধাবিত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের শ্রমিক ফ্রন্ট হিসেবে জাতীয় শ্রমিক লীগ গঠন করেন এবং মস্কোপন্থি ও চিনপন্থি কমিউনিস্টদের কবল থেকে শ্রমিক আন্দোলনকে উদ্ধার করে জাতীয় মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেন। প্রকাশ্য শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি ১৯৬৮ সালে নিউক্লিয়াসের রাজনৈতিক ও সামরিক শাখা হিসেবে সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াস নেতৃত্ব গড়ে তোলেন ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট’ বা বিএলএফ। বিএলএফ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে জঙ্গিরূপ রূপ দিতে গণআন্দোলনে সীমিত পরিসরে বল প্রয়োগের কাজ শুরু করে। কারান্তরীণ শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার জন্য পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে বিচার কার্য শুরু করলে সিরাজুল আলম খান বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচাতে মস্কোপন্থি ও চিনপন্থিদের সাথে ১১ দফা ভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলেন; মস্কোপন্থিরা ছয় দফায় ঘোষিত পূর্ব বাংলার জন্য আলাদা মুদ্রার ব্যাপারে একমত না হলে, এই একটি বিষয় বাদ দিয়ে ছয় দফার বাকি সব দফা যুক্ত করে ১১ দফা গ্রহণ করেন। সিরাজুল আলম খান ও নিউক্লিয়াসের তখন একটাই শপথ, যে কোনো মূল্যে শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা করতে হবে। ১১ দফার ভিত্তিতে দুর্বার ছাত্র আন্দোলনকে নিউক্লিয়াস ‘ছয় দফা না হলে এক দফা’র (অর্থাৎ স্বাধীনতা)আন্দোলনে পরিণত করেন। এক দফা বা স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার এই পর্যায়ে সিরাজুল আলম খানের অনুসারীগণ গভীর জাতীয়তাবাদী জনপ্রিয় স্লোগানগুলোর জন্ম দেন; এই সময়ই তাঁরা মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় বাঙালির জাতীয় রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ স্লোগান প্রবর্তন করেন। বিদ্যুৎগতিতে তা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয় রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’ প্রবর্তনের পর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্ত শেখ মুজিবকে অতি দ্রুত ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এককভাবে সংবর্ধনা প্রদান করে নিউক্লিয়াসের পক্ষে তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য ১৯৬৯-১৯৭০ সালের ছাত্রলীগ সভাপতি তোফায়েল আহমেদ জনসভায় শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু উপাধি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করলেও এর আগেই ১৯৬৮ সালের ৩রা নভেম্বর ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের দেয়ালিকা পত্রিকা ‘প্রতিধ্বনি’তে ছয় দফার পক্ষের একটি রচনায় নিউক্লিয়াসপন্থি ছাত্রনেতা রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক সর্বপ্রথম শেখ মুজিবের জন্য বঙ্গবন্ধু অভিধাটি ব্যবহার করেন। ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এই প্রস্তুতিকালে সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার পক্ষের তরুণ নেতৃত্বকে নির্বাচনের প্রার্থী করতে বঙ্গবন্ধুকে সহায়তা করেন। ১৯৭০ সালের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জাতীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিরুত্তাপ মনে হলেও নিউক্লিয়াস এই সময়টিকে বঙ্গবন্ধু ও সিরাজুল আলম খান স্বাধীনতার দাবি এগিয়ে নিতে বহুবিধ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ১৯৭০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হকের প্রথম শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে ‘সার্জেন্ট জহুর বাহিনী’ বা ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’ গঠন করেন ও কুচকাওয়াজ করে তাঁর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
১৯৭০ সালের ৭ জুন পল্টন ময়দানে ১৯৬৬ সালের ৭ জুনের ধর্মঘটটি শ্রমিকদের শহিদ হবার দিন হওয়ায় এদিনে পল্টন ময়দানে শ্রমিক সমাবেশ আয়োজন করা হয়; এতে বঙ্গবন্ধু বক্তব্য রাখেন। নিউক্লিয়াস ‘ফেব্রুয়ারি ১৫ বাহিনী’কে ‘জয় বাংলা বাহিনী’ নাম দিয়ে সামরিক কুচকাওয়াজ করে শহর প্রদক্ষিণ করে সমাবেশস্থলে এসে বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানিয়ে তাঁর হাতে ‘জয় বাংলা বাহিনী’র রেজিমেন্টাল ফ্ল্যাগ হস্তান্তর করেন। পতাকাটি তৈরি করা হয় ৬ জুন শেষ রাতের দিকে, অর্থাৎ ৭ জুন ভোরে। জয়বাংলা বাহিনীর এই রেজিমেন্টাল ফ্ল্যাগটিই পরে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট ছাত্রলীগের বধির্ত সভায় স্বপন কুমার চৌধুরীর প্রস্তাবনার ভিত্তিতে ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৯৭০ সালেই বঙ্গবন্ধু নিউক্লিয়াস পরিচালিত আন্দোলনকে সশস্ত্র রূপ দিতে সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে কাজী আরেফ আহমেদের নেতৃত্বে অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের লক্ষ্যে এবং স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে ধাবিত করতে সিরাজুল আলম খান একটি ‘মেগা প্রকল্প’ গ্রহণ করেন। তিনি নিউক্লিয়াস ও ছাত্রলীগের নেতা মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনিকে দেড় হাজার প্রশিক্ষিত ছাত্রলীগ নেতা কর্মীকে পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পণ করেন, যাঁরা তিন থেকে পাঁচ জনের ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পূর্ব বাংলার প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারণা চালান ও নির্বাচনকে স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি কৌশল হিসেবে প্রয়োগ করেন। ‘জয় বাংলা’ নামের একটি প্রকাশিত ইশতেহারে নির্বাচন বিষয়ে ছাত্রলীগ নেতৃত্ব ও অগ্রসর জনগণের জন্য করণীয় বিবৃত করা হয়। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে স্বাধীনতাপন্থি নিউক্লিয়াসের সাথে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরের স্বায়ত্তশাসনপন্থিদের দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে নির্দেশ দেন সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনার জন্য। তিনি এসময় এই চার যুব নেতাকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী চিত্তরঞ্জন সুতারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে অধিবেশন স্থগিত করলে গণবিস্ফোরণ সংঘটিত হয়। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে নিউক্লিয়াস এই গণবিস্ফোরণকে সুচারুভাবে সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে পরিচালিত করতে থাকে। তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে রাসায়নিক পদার্থ ও সমরাস্ত্র লুট ও সংগ্রহ করতে থাকেন। পূর্ব বাংলার প্রতিদিনের সরকারি-বেসরকারি-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের সকল কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসারে। ১৯৭০ সালের ৭ই জুন যে পতাকাটি জয় বাংলা বাহিনীর রেজিমেন্টাল ফ্ল্যাগ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে হস্তান্তর করা হয়, হাসানুল হক ইনু সে পতাকাটি রাখতে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতা শেখ জাহিদের কাছে। শেখ জাহিদ ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ সে পতাকাটি নিয়ে মিছিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আসেন, ছাত্র নেতা আসম আব্দুর রব সেই পতাকাটি জনগণকে প্রদর্শন করেন। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ নিউক্লিয়াসপন্থিদের উদ্যোগে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর সমন্বয়ে গঠিত ‘স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ কর্তৃক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রজনসভায় বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়।
স্বাধীনতার ইশতেহারে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়, সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণে নিউক্লিয়াসপন্থিদের বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটে। সবশেষে ১লা মার্চ সূচিত অসহযোগ আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতিতে পৌঁছে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে সারাদেশে পাকিস্তানের পতাকা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের কবর রচনা করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণের উপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ হাতে ঝাঁপিয়ে পরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ যে কয়েকজন ব্যক্তির ‘হোয়্যারঅ্যাবাউট’ তাদের লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করে, সেই তালিকায় পাঁচ নম্বরে ছিলো সিরাজুল আলম খানের নাম। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। প্রথাগত সামরিক কায়দায় মুক্তিবাহিনী গঠন করা হয়। ১১টি সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ কার্যক্রম শুরুর পাশাপাশি চারটি সেক্টরে যুদ্ধ পরিচালনা করে বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট বা বিএলএফ।
বিএলএফ-এর চার সেক্টরের একটি সেক্টর পরিচালনা করেন সিরাজুল আলম খান নিজেই; তাঁর ডেপুটি ছিলেন মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি। সকল সেক্টরের জন্য দেরাদুনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রধান ছিলেন হাসানুল হক ইনু। অক্টোবর থেকে বিএলএফ মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত হতে থাকে। দেশের অনেক অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনী একসাথে যুদ্ধ পরিচালনা করে, কোথাও কোথাও মুজিব বাহিনীর কমান্ডার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।