ফকির লালন শাহ গেয়েছিলেন, ‘সময় গেলে সাধন হবে না…!’ আসলেই সময়ের কাজ সময়েই করতে হয়। না হলে আক্ষেপ করেও লাভ হয়না। আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ অভিযানে আসার আগে অনেক কিছুই করার ছিল বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের, ক্রিকেটারদের। কিন্তু সেসব তারা করেনি। যার মাশুল গুণে দল হেরেছে টানা ৫ ম্যাচ, তাতে ব্যর্থতার ইতিহাসটা সমৃদ্ধ হয়েছে আরও। এখন অবশ্য নড়েচড়ে বসেছেন বোর্ড কর্তারা। বাংলাদেশ ক্রিকেটে কিছু পরিবর্তনের জোর গুঞ্জন-যার উত্তাপ এসে লাগছে এই দুবাই শহরেও। কান পাতলে এখান থেকেও কিছু উড়ো খবর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে!
গত কিছুদিন অবশ্য অনেক ব্যস্ততাতেই ছিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। ওমানে বাছাই পর্বে স্কটল্যান্ডের কাছে দল হারের পরই বিতর্কের ঢাকে বাড়ি দিয়ে তিনি চলে যান উমরাহ পালন করতে। এখন আবার চলে গেছেন ইংল্যান্ডে। তার মধ্যেই বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। জাতীয় দলটাকে কী করে পথে ফেরানো যায় সেই ভাবনাতেও সময় কেটেছে তার।
তবে তার আগে মস্ত বড় একটা ভুলও করে বসেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। যাকে নিয়ে বিতর্কের পাহাড়। যিনি বাংলাদেশ দলের কোচ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন কি না, সে নিয়েই আছে প্রশ্ন; সেই রাসেল ডমিঙ্গোর সঙ্গে চুক্তির মেয়াদটা বাড়িয়েছে দুই বছর। অথচ তাকে ছেটে ফেলার দাবিটাই তো সবচেয়ে জোড়ালো। কিন্তু এই বিশ্বকাপের আগেই বিসিবি সঙ্গে দুই বছরের নতুন চুক্তির প্রক্রিয়া করে ফেলেন ডমিঙ্গো।
তার নাকি অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ার কোচ হওয়ার প্রস্তাব এসেছিল। সেটি জানিয়ে বিসিবিকে সাফ বলে দেন নতুন চুক্তি বিশ্বকাপের আগেই করতে হবে না হলে তিনি উড়াল দেবেন অস্ট্রেলিয়ায়। বিসিবি কী বুঝে তখনই সব চূড়ান্ত করে ফেলে। এমন কী এই দক্ষিণ আফ্রিকানের বেতন প্রায় আরও ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়! এখানেই শেষ নয়, চুক্তির শর্ত মতে দুই বছরের চুক্তির প্রথম এক বছরে বিসিবি বরখাস্ত করতে চাইলে কিংবা তিনি চাকরি ছাড়তে চাইলে দিতে হবে আর্থিক ক্ষতিপূরণ। মানে ডমিঙ্গোকে ছাটাই করতে চাইলেও এখন এক বছরের বেতন দিতে হবে। জানিয়ে রাখা ভাল এবার তার বেতন মাসে ২২ হাজার ডলার। যা আয়কর দিয়ে কমে দাঁড়াবে প্রায় ১৭ হাজার ডলার।
মানে দলে যতো বিল্পবই হোক, আপাতত ডমিঙ্গোকে নিয়েই ভাবতে হবে বিসিবির। যদিও জোর গুঞ্জন ফের কড়া হেড মাস্টার চন্ডিকা হাথুরুসিংহেতেই নাকি ফিরতে চায় বিসিবি। কথা চলছে সাবেক কোচ জেমি সিডন্সের সঙ্গেও। তাদের পেয়ে গেলে হয়তো ক্ষতিপূরণ দিয়েই ডমিঙ্গোকে দেশে ফেরার টিকিট দিয়ে দেবে বিসিবি। বিশ্বকাপ ব্যর্থতার পর কারণ তাকে আর টানতে চায় না বোর্ড।
আরও এক উড়ো খবর- তামিম ইকবালকে নাকি পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে খেলার প্রস্তাব দিয়েছেন নাজমুল হাসান পাপন। মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে সরিয়ে তাকে অধিনায়ক করার প্রস্তাবও এসেছে। কিন্তু প্রচণ্ড আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন তামিম সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন সবিনয়ে। বিশ্বকাপ থেকে সরে দাঁড়ানো তামিম এবারও তরুণদের প্রাধান্য দিয়ে দল গড়তে বললেন।
এরমানে আসন্ন পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে টি-টোয়েন্টির নেতৃত্ব থাকছে মাহমদুউল্লাহ রিয়াদের কাঁধেই। তিনি অবশ্য দুবাই ছাড়ার আগেই বিসিবির কোর্টে বল ঠেলে দিয়েছেন। বোর্ড যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই মেনে নেবেন তিনি।
এটা ঠিক হয়ে গেছে পাকিস্তান সিরিজে কিছু নতুন মুখ উঠে আসবে বাংলাদেশ দলে। নতুন মুখ দেখা যেতে পারে টি-টোয়েন্টি সিরিজে। এটা নিশ্চিতই হয়ে গেছে প্রবল সমালোচনায় থাকা লিটন কুমার দাস ও সৌম্য সরকার কিছুদিনের জন্য বাদই যাচ্ছেন। তাদের অনেক দেখা হয়েছে। কিন্তু সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন নি বলে এবার ছিটকে যাচ্ছেন দু’জন। এ অবস্থায় নাজমুল হোসেন শান্ত, পারভেজ হোসেন ইমন, ইয়াসির রাব্বি, ইরফান শুক্কুরের মতো তরুণ ক্রিকেটাররা পাকিস্তানের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ডাক পেতে পারেন।
বলা হচ্ছিল টি-টোয়েন্টি থেকে বাদ যেতে পারেন মুশফিকুর রহিম। নুরুল হাসান সোহান উইকেট কিপিং করায় এখন স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান হিসেবেই একাদশে জায়গা মেলে তার। কিন্তু সেখানেও তিনি ফ্লপ। এ অবস্থায় তাকে টেনে নেওয়া কতো যুক্তিসংগত সেটাও ভাবা হচ্ছে। তবে পাকিস্তানের বিপক্ষে এ মাসের সিরিজে স্রেফ অভিজ্ঞতার কারণে টিকে যেতে পারেন মুশফিক। কিন্তু প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর ভাগ্য ঝুলছে সুতোর ওপর। তাকে নির্বাচকের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হতে পারে অন্য কোথায়ও। হাবিবুল বাশারের চেয়ারটাও নড়বড়ে। কিন্তু টিকে যাচ্ছেন আরেক নির্বাচক আব্দুর রাজ্জাক।
মাঠের বাজে পারফরম্যান্স আর মাঠের বাইরের সমালোচনার তোপে গোটা বাংলাদেশ দলটাই বিধ্বস্ত। কিন্তু এই ধাক্কা সামলে উঠার আগেই তাদের লড়তে হবে পাকিস্তানের সঙ্গে। দেশের মাঠে সেই টি-টোয়েন্টি আর টেস্ট সিরিজে সাকিব আল হাসানকে পাওয়া অনিশ্চিত। হ্যামস্ট্রিংয়ের চোটে তিনি বিশ্বকাপ থেকেই মাঠের বাইরে। এই অবস্থায় দলটাকে চাঙ্গা করার দ্বায়িত্ব পেয়েছেন খালেন মাহমুদ সুজন। পাকিস্তান সিরিজে টিম ডিরেক্টর হিসেবে যুক্ত করা হচ্ছে তাকে। যিনি দায়িত্বটা পেয়েই বড় ভাই সুলভভাবে সবাইকে ধৈর্য ধরতে বললেন।
এখানেই শেষ নয়, আমিরাতের বিশ্বকাপে ব্যর্থতার কারণটাও খুঁজে দেখতে চায় বিসিবি। এ কারণে ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি’ গঠন করার কথা ভাবছে তারা। যেখানে টিম ম্যানেজম্যান্ট, ক্রিকেটার, নির্বাচক, সাংবাদিক আর খেলা দেখতে যাওয়া দর্শকদের সঙ্গেও কথা বলবেন তারা। যদিও এমন কিছু হবে, এটা নিশ্চিত নয়। বিসিবি সভাপতি ইংল্যান্ড সফর শেষে ফিরলে হয়তো এ নিয়ে মিলবে সঠিক খবর।
এমনকি নিশ্চিত নয়, বাংলাদেশের উইকেটগুলো আদৌ স্পোর্টিং হবে কি না সেই বড় প্রসঙ্গটিও। নাকি পাকিস্তানকে নিজ দেশে ডেকে এনে স্লো আর টার্নিং উইকেটে হারিয়ে দিতে পারলেই আমরা অতীতের সব দুঃস্বপ্ন ভুলে যাবো। মনেও করবো না টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে টানা ৫ ম্যাচ হেরেছে দল! তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে, দেশের বাইরে সাফল্য পেতে হলে এখনই সব ঝেড়ে ফেলতে হবে। নগদ লাভের আশার চেয়ে তাকাতে হবে সামনে। আসছে বছর ফের আরেকটি বিশ্বকাপ। সময় দ্রুত যাচ্ছে। ঠিক তাই, সময় গেলে সাধন-হবে না!